প্রান্তিক আদিবাসী যাপনের খুঁটিনাটি – প্রত্যন্ত জীবনের খোঁজে
আদিবাসী কারে কয় ?
আদিবাসী অর্থাৎ ইংরেজি ট্রাইব শব্দটি ল্যাটিন ট্রাইবাস থেকে। রোমানরা এই শব্দটা প্রযুক্তিগতভাবে অনুন্নত গোষ্ঠী বা জনজাতি বোঝাতে ব্যবহার করত।
ব্রিটিশ তাত্ত্বিকেরা প্রান্তিক আদিবাসী রূপে চিহ্নিত করেছিলেন সেই সব জনগোষ্ঠীকে যারা ভারতে প্রচলিত বর্ণাশ্রম প্রথার অন্তর্ভুক্ত নয় এবং যারা সাধারণত লোকালয় থেকে দূরে কোনো বিচ্ছিন্ন দুর্গম অঞ্চল যথা পার্বত্য বা অরণ্যভূমিতে বসবাস করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে আদিবাসী সম্প্রদায়ের সম্পর্কে একটি বিস্তারিত ডেসক্রিপশন দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে, “যে প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলো ভৌগোলিকভাবে স্বতন্ত্র ঐতিহ্যবাহী বাসস্থান বা পূর্বপুরুষের অঞ্চলগুলির মধ্যে বসবাস করে বা সংযুক্ত থাকে ও যারা নিজেদেরকে একটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে, তৎসঙ্গে আদি জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি বজায় রাখে, তারাই আদিবাসী।”
জনগনকে সাধারণত আদিবাসী হিসেবে বর্ণনা করা হয় যখন তারা একটি প্রদত্ত অঞ্চলের প্রথম বাসিন্দাদের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহ্য বা প্রাথমিক সংস্কৃতির অন্যান্য দিকগুলো বজায় রাখে। সমস্ত আদিবাসীদের এই বৈশিষ্ট্য থাকে না, কারণ অনেকেই একটি ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির উপাদান গ্ৰহন করেছে। তার মধ্যে পোষাক, ভাষা এবং খাদ্য উল্লেখযোগ্য।
আদিবাসীদের অধিকার
আন্তর্জাতিক সীমানা দ্বারা বিভক্ত এই জনগোষ্ঠীগুলোর অন্য কোনো প্রান্তের নিজস্ব জনগোষ্ঠী বা অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আন্তর্যোগাযোগ রেখে নিজেদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কার্যক্রম বজায় রাখতে পারার সম্পূর্ণ অধিকার আছে।
আদিবাসীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় এরা সাধারণত ঐতিহাসিকভাবে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত থাকে, যার উপর তাদের প্রান্তিক জীবনযাত্রা নির্ভরশীল। এখানে উল্লেখযোগ্য, সারা পৃথিবীতে প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি আদিবাসী সম্প্রদায় আছে। বিশ্ব জনসংখ্যার গণনায় জানা যায়, সারা পৃথিবীতে প্রায় ষাট কোটি মানুষ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর।
আদিবাসী এবং উপজাতিদের মধ্যে পার্থক্য
যে জনগোষ্ঠী কোনো জায়গায় আদিকাল থেকে বসবাস করছে তারা হল আদিবাসী, আর উপজাতি হল তুলনামূলক পুরোনো সামাজিক একটা প্রাক-স্থায়ী সংগঠন, যা রক্তের বন্ধনের মতন কিছুর উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। বেশিরভাগ উপজাতিই পরিবারের সম্প্রসারণ।
আদিবাসীদের জনসংখ্যার অনুমান 250 মিলিয়ন থেকে 600 মিলিয়ন পর্যন্ত। আন্টার্কটিকা ছাড়া পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি জনবসতিপূর্ণ জলবায়ু অঞ্চল এবং মহাদেশ জুড়ে সাত হাজার ভাষায় কথা বলা এই প্রায় লুপ্ত মানুষগুলো পাঁচ হাজারের অধিক সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করছে। নব্বইটি দেশ জুড়ে তাদের বসবাস। তারা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশের কম হলেও দরিদ্রতম পনেরো শতাংশের মধ্যে তারাই প্রধানতম।
সমাজে পরিবর্তন
সময়ের সাথে সাথে সমাজের অর্থনৈতিক প্রয়োজন সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন ঘটায়। সমাজের প্রতিষ্ঠিত বর্ণগুলো নানা উপজাতিতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
ভারতীয় উপমহাদেশের আদিবাসী
আদিবাসী শব্দটি সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে পাওয়া উপজাতীয় সম্প্রদায়কে বোঝায়। রাজনৈতিক কর্মীরা 1930 সালে সরকারের প্রতি আদিবাসীদের নিজস্ব ঐতিহ্য রক্ষা এবং পরিচয় দেবার দাবি জানায়। ভারতীয় উপমহাদেশের আদিবাসী তালিকা থেকে নিম্নোক্ত নামগুলো পাওয়া যায়।
ভারত থেকে বানজারা, কুরুবা, কোডাভা, ইরুলা, গোন্দ, কিষাণ, কোটা, টোডা, বদাগা, ডোগ্ৰাস, থারু ইত্যাদি।
এছাড়া ইরাণের পশতুন, বেলুচ, মালদ্বীপের জিরাভারু, পাকিস্তানের শিনা, দরদ, কালশা, পোথওয়ারী, সরাইকি ইত্যাদি।
অন্যান্য দেশের মধ্যে চীন- তিব্বতী ভাষী মানুষ, বোডিশ জনগণ, কুকিশ, রাজি -রাউতে, জুম্ম উল্লেখযোগ্য।
পরস্পর বিরোধী সংজ্ঞা বা ভিন্ন ভিন্ন মত থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে একটি সাধারণ সংজ্ঞার মতো কোনো স্থির দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে আদিবাসী জীবন ও সমাজের মতো একটি বর্ণময়, বৈচিত্র্যপূর্ণ ও ক্রম পরিবর্তনশীল বিষয়কে সম্পূর্ণ রূপে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়। এ কারণেই আদিবাসী বিষয়ে আলোচনাকালে নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিকরা এদের কতকগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে একমত হয়েছেন। এগুলো হল, সাধারণ নাম, নির্দিষ্ট বাসস্থান, সাধারণ ভাষা, ঐক্যভাব, রক্ত সম্পর্কের বন্ধন, সংস্কৃতি, আন্তর্বিবাহ ইত্যাদি।
জাতিসংঘের আদিবাসী সংক্রান্ত কর্মদলের প্রথম সভা ৯ই আগস্ট ১৯৮২-এ হয়েছিল। এই তারিখটি এখন আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস হিসেবে পালিত হয়।