Kahhak Publishers blog

কৈশোরের অন্ধকার মন খোঁজার চাবিকাঠি

“ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিচিত্র সাধ কবিতায় এক জায়গায় লিখেছেন “ইচ্ছে করে আমি হতেম যদি/ বাবুদের ওই ফুল-বাগানের মালী”| আবার লিখেছেন “ইচ্ছে করে পাহারওলা হয়ে গলির ধারে আপন মনে জাগি”।  এই ‘ইচ্ছে’ বস্তুটা বড় অদ্ভুত কৈশোর জীবনে। খুবই অস্থির। কৈশোরেই যত বিচিত্র ইচ্ছের সাধ জাগে। শৈশব থেকে যৌবনে পা দেওয়ার মধ্যবর্তী পথটা কখনো মনে হয় পাহাড়ি রাস্তার মতো, কখনো বা উত্তাল সমুদ্র আবার মনে হয় যেন জ্যোৎস্না রাতের মতো স্নিগ্ধ। সবটাই মনের উপর নির্ভর করছে। নানা জটিলতায় ভরপুর আজকের কৈশোরের সঙ্গে অতীতের কৈশোর যাপনের প্রায় কোনো মিলই নেই। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে যাপনের পদ্ধতি পালটেছে অনেক। বড় হওয়ার পথে নানা প্রতিকূলতার শিকার আজকের কৈশোর। প্রত্যেকটি কিশোর জীবন আজ কিছু না কিছু ভাবে সমস্যা সঙ্কুল জীবনের মুখোমুখি। ওই কাঁচা বয়সে সেসব সামলে চলা সত্যিই কঠিন। অবুঝ মনটা যত বেশি হোঁচট খায় তত বুঝতে শেখে জীবনে চলতে গেলে চোখ কান খোলা রেখে চলতে হয়। তাইতো রবিঠাকুর বলেছেন, ‘শিক্ষার সকলের চেয়ে বড় অঙ্গটা—বুঝাইয়া দেওয়া নহে, মনের মধ্যে ঘা দেওয়া।’ তবে শুধু সন্তানদের উপর এই দায় বর্তায় না, টিনেজ সাইকোলজি নিয়ে সমাজকেও রীতিমতো ওয়াকিবহাল থাকতে হবে।

“ধাঁধার থেকেও জটিল তুমি”

আমাদের বয়সের স্তরগুলির মধ্যে এই টিন-এজ সময়টা সবচেয়ে জটিল। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, ওই সময় ব্রেনের গঠন অনেকটা প্লাস্টিকের মতো হয়। ঠিক যেভাবে গড়া হবে সেভাবেই শেপ নেবে। তখন ব্রেন হয় অত্যন্ত স্পর্শকাতর। বাকি জীবনের পথচলা কেমন হবে তা প্রায় সিংহভাগ নির্ভর করে এই কৈশোরে কাটানো দিনগুলোর উপর। অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার আদর্শ সময় হল টিন-এজ। ভুল এবং সঠিক পথের মধ্যে সূক্ষ্ম তফাৎ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করার সময় হল এই  টিন-এজ। মনকে নিজের বশে রাখার কঠিন পরীক্ষার সময় এই  টিন-এজ। কৈশোর জীবনে ব্রেনের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স বিচার-বিবেচনা, সেল্ফ-কন্ট্রোল, ইমোশনাল কন্ট্রোল ইত্যাদির জন্য নির্ভরশীল। যতক্ষণ না টিন-এজ ছেলেমেয়েরা ‘অতিসক্রিয় ইঞ্জিনগুলিতে’ লাগাম কষতে পারছে, ততক্ষণ উচিত তাদের গাইড করা, সাপোর্ট দেওয়া এবং সহানুভূতিশীল হওয়া। কাঁচা মনগুলো তখন হাতড়ে বেড়ায় একটু সংবেদনশীল স্পর্শ পাওয়ার জন্য। যে স্পর্শ শান্ত হতে শেখাবে। 

বয়ঃসন্ধিকালে ঝুঁকির অনুভূতির প্রতি তাদের একই প্রতিক্রিয়া থাকে যেমনটি তারা পুরস্কারের অনুভূতিতে করে। এই প্রতিক্রিয়াটি সচেতন সিদ্ধান্ত গ্রহণকে অগ্রাহ্য করে এবং তাদের সম্ভাব্য বিপদগুলিকে উপেক্ষা করার সম্ভাবনাকে বেশি করে তোলে। এই পরিস্থিতি সমবয়সীদের উপস্থিতিতে আরো বেশি হয়। কারণ সমবয়সীদের থেকে স্বীকৃতি পাওয়া বা তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হওয়ার অনুভূতিটাই কিশোরদের বেশি উত্তেজিত করে তোলে। যেন এটাই সেরা উপহার। ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলোতে তারা যদি সত্যিই মেতে উঠতে থাকে তবে সেটা ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক। তাই আমাদের উচিত সম্ভাব্য ক্ষতিগুলো নিয়ে আলোচনা করা। কৈশোর মনস্তত্ব নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। 

সমীক্ষায় দেখা গেছে দশ থেকে উনিশ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে ১৪% কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ। আর এই সংখ্যাটা যত বাড়ছে ততই বাড়ছে সমাজে ক্রাইমের সংখ্যা। কিশোর জীবনেই তারা মুখোমুখি হয় শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে। এর ফলে বাড়তে থাকে শিক্ষাগত অসুবিধা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, শারীরিক অসুস্থতার প্রবণতা। ডিপ্রেশন এবং উদ্বেগ তাদের নিত্য সঙ্গী। বলা বাহুল্য কৈশোরের উপর এসব শয়তানদের প্রকোপ দিনদিন বেড়েই চলেছে। যেসব তাজা প্রাণে রঙের ছটা থাকার কথা, নরম ঘাসের গালিচায় শুয়ে নীল আকাশ আর সবুজ মাঠের মিলন দেখার কথা, তারা হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের চোরাগলিতে। সেইসব অসহায় কিশোরদের সাহায্যের প্রয়োজন।

একটা ফুটফুটে জীবন পেতে গেলে দরকার সূর্যের কিরণের মতো উজ্জ্বল কৈশোর। যেখানে ভরপুর থাকবে শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ড, খেলাধুলা এবং হাসি-ঠাট্টা। যে সময় জুড়ে থাকবে শুধু মায়া মাখানো স্মৃতি। যে সময়টা মনে পড়লে দুঃখের নয়, আনন্দের অশ্রু ঝরবে গাল বেয়ে। এমন একটা কৈশোর প্রতিটা মানুষের প্রাপ্য। অবুঝের পেন্সিল হাতে তারা আঁকিবুকি কাটতে কাটতে এঁকে দেবে একটা নৈসর্গিক জীবন।

Post a Comment

Kahhak Publishers
8/1A, Hindustan Park, Kol- 29 83369 66166 publishers@kahhak.com


    Request a Callback
    Icon